প্রতিরোধই শ্রেষ্ঠ উপায়,
আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যবস্থা।
ডক্টর শিবেন্দ্র কর্মকার
এডাপটো-মেডিসিন কনসালটেন্ট
এডাপটো-মেডিসিন কনসালটেন্ট
ক্যানসার রোগ বুঝতে হলে আগে ‘কোষ’ সম্পর্কে বুঝতে হবে। কারণ ক্যানসার মূলতঃ কোষেরেই একটি রোগ।
এভাবে মানব দেহে ৩০০ ধরনের প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন কোষ রয়েছে,যারা সবে মিলে মিশে ৭লক্ষ কার্য সম্পাদন করে থাকে। প্রত্যেকটি কোষ একটি ব্যস্ত কারখানা। বিভিন্ন ধরনের বিলিয়ন বিলিয়ন রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে চলছে এবং প্রত্যেকটি রাসায়নিক পদার্থ দেহ ব্যবস্থা কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আলাদা আলাদা কাজ করে যাচ্ছে। প্রত্যেক কোষের একটি পর্দা আছে যা অত্যান্ত সুনির্দিষ্ট কৌশলের মাধ্যমে কোষের ভিতর ও বহিরের পদার্থ গুলির যাতায়ত নিয়ত্রন করে। বিশেষ করে অপ্রোয়জনীয় পদার্থের প্রবেশ প্রতিহত করে। কোষের ভিতরে উৎপন্ন বর্জ গুলি বের করে দিয়ে কোষ কে বর্জ মুক্ত রাখে। প্রত্যেকটি কোষের একটি কেন্দ্র আছে। এটিকেই ‘নিউক্লিয়াস’ বলে। এই ‘নিউক্লিয়াস ’অতি বিস্ময়কর একটি রাসায়নিক পদার্থ ধারন করে। এটিই DNA অর্থাৎ ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড। এই ডিএনএ ই মূলতঃ কোষের সকল কাজের নিয়নন্ত্রক। অর্থাৎ সকল ধরনের রাসায়নিক পদার্থের তৈরি এবং কাজের নির্দেশ আসে এই DNA থেকেই। বিজ্ঞানীরা একটি কোষের নিউক্লিয়াসে ৩ বিলিয়ন নির্দেশিকা আবিষ্কার করেছেন। এটিই হিউমেন জেনোম অথাৎ মানব কোষের DNAএর মানচিত্র। এই নিউক্লিয়াসটি কোষের তরল পদার্থের মধ্যে ভাসমান অবস্থায় থাকে। এই তরল পদার্থ কেই ‘সাইটোপ্লাজম’ বলে। এই সাইটোপ্লাজমের মধ্যেই কোষের খাদ্য হজম হয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। কোষের খাদ্য ‘গ্লুকোজ’ ২৫ টি রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পানি ,শক্তি (এটিপি) এবং কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন করে। এই শক্তি (ATP)দেহের পেশীর নড়াচড়া থেকে শুরু করে ,দেহের অভ্যন্তরিন (হার্ট,কিডনি,লিভার,ব্রেইন,ফুসফুস) অঙ্গ গুলোর কাজকে সচল রাখার কাজে ব্যয় হয়। এই শক্তির একটি অংশ এনজাইম,হরমোন ও এন্টিবডি সংশ্লেষনের কাজে ব্যবহৃত হয়। এই সবকিছুই কোষের ‘সাইটোপ্লাজমে’ সংগঠিত হয়। মানব দেহ কোষ গুলো রাতদিন ২৪ ঘন্টা অনবরত কাজ করে যাচ্ছে, দেহ ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তবে প্রতিটি কোষের দায়িত্ব পালন এবং বেঁচে থাকার জন্য অন্যান্য কোষের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। প্রতিটি কোষের খাদ্য গ্রহণ,বর্জ বর্জন এবং আত্ম রক্ষার কৌশল থাকতেই হবে। নচেৎ কোষ বেঁচে থাকতে পারেনা।
দেহে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে লাল রক্ত কোষ। এদের সংখ্যা প্রায় ৩০ট্রিলিয়ন। মানব দেহের সকল অঙ্গ গুলির বাহিরে এবং ফাঁপা অঙ্গ গুলোর ভিতর একটি প্রতিরক্ষা কোষের স্তর দ্বারা আবৃত থাকে। এই বিশেষ কোষ গুলিকে ‘এপিথেলিয়াম কোষ’ বলে। চর্ম কোষের আবরনী ‘এপিথেলিয়াম কোষকে ‘এপির্ডামিস’ বলে। ফাঁপা অংঙ্গ গুলোর (যেমন,হার্ট, ফুসফুস রক্তনালী ) ভিতরের স্তর ‘এপিথেলিয়াম ’ এর স্তর দ্বারা নির্মিত। রক্ত নালীর ভিতরের ‘এপিথেলিয়াম’ এর স্তর কে ‘এন্ডোথেলিয়াম’ বলে।
দেহের প্রয়োজনেই কোষে এই বিভাজন প্রক্রিয়া চলে। দেহে দুই ধরনের কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া চলে। দেহ কোষের যে বিভাজন প্রক্রিয়া চলে , একে ‘মাইটোসিস’ এবং যৌন কোষে যে বিভাজন চলে একে ‘মিয়োসিস’ বলে। দেহ কোষ বিভাজন হয়ে হুবহু দুটি কোষে পরিণত হয়। অর্থাৎ প্রতিটি কোষ বংশ গতির পুরো তথ্য ধারন করে। যৌন কোষ বিভাজনে সৃষ্ট দুটি কোষের প্রতিটি বংশ গতির অর্ধেক তথ্য ধারন করে। অর্থাৎ প্রতিটি মানব কোষে বংশ গতির তথ্য ধারনকারী ‘ক্রমোজম’ এর সংখ্যা ৪৬টি। অন্য দিকে প্রতিটি যৌন কোষে (শুক্রানু ও ডিম্বানু) বংশ গতির তথ্য ধারনকারী ‘ক্রমোজম’এর সংখ্যা ২৩টি।
একটি শুক্রানু ও একটি ডিম্বানুর মিলনের ফলে যে মানব কোষের জন্ম হয় মূলতঃ এটিই ভ্রুণ। এ ভ্রুনটিই পর্যায়ক্রমে বিভাজিত হয়ে ১০ মাস ১০দিনে একটি পূর্নাক্সগ মানব শিশুতে পরিণত হয়। একটি কোষ এর ৪৬টি ক্রমোজমে ৩ বিলিয়ন তথ্য সংরক্ষনের ব্যবস্থা রয়েছে। কোষ বিভাজনের সময় কোষের এই পুরো তথ্য ভান্ডার এর কপি সৃষ্ট কোষটি তে হুবহু স্থানান্তরিত হয়। কোষের এই বিভাজন প্রক্রিয়া মৃত্যু পর্যন্ত চলে।
নিন্মে দেহ কোষের বিভাজনকাল ও জীবনকাল দেয়া হলো:
Cell
Type
|
Process
|
Time
|
fly embryo
|
8 minutes
|
|
bacteria
|
mitosis
|
20 minutes
|
mitosis
|
2 hours
|
|
human skin
|
mitosis
|
20 - 24 hours
|
human sperm
|
about 64 days
|
|
human liver
|
mitosis
|
1 year or more
|
human egg
|
meiosis
|
up to 40 years or more
|
human nerve
|
mitosis
|
never, once mature
|
এ মানব ভ্রুণের ওজন ১ ন্যানোগ্রাম (১ ন্যানোগ্রাম =১ গ্রামের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ।) এ মানব ভ্রুণের আয়তন .৬মিলিমাইক্রন (১মাইক্রন = ১মিটারের ১০লক্ষ ভাগের ১ভাগ।
দেহের প্রয়োজন ছাড়া কোষ বিভাজন ঘটে না। অপ্রয়োজনীয় কোষ বিভাজন ঘটে না বলেই দেহের ভিতর ও বাহির এর অঙ্গ গুলোর আকার সব সময় একই রকম থাকে। শুধু দেহ অঙ্গের অসুখ হলে ,কোষের স্বাভাবিক আকারের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। এভাবে একটি কোষের প্রয়োজন ছাড়া অনিয়মিত বিভাজন কে ‘টিউমার’বলে। মানব কোষে দুই ধরনের ‘টিউমার’ হয়।
১) বিনাইন টিউমার বা ক্ষতি কারক বৃদ্ধি নয়।
২) ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বা ক্ষতি কারক বৃদ্ধি।
বিনাইন টিউমার বা ক্ষতি কারক বৃদ্ধি নয়:(এডেনোমা)
বিনাইন টিউমার ক্ষতি কারক নয়। তবে দেহের গুরুত্ব পূর্ন স্থানে এই ধরনের বৃদ্ধি জীবন শংকার কারণ হতে পারে। যেমন চর্মের উপর এ ধরনের টিউমার সৌন্দর্য হানী ঘটায়। আবার মস্তিষ্ক,হৃদপিন্ড,ফুসফুস,লিভার, কিডনি ও রক্তনালীর ভিতর এই ধরনের টিউমার অঙ্গ গুলোর স্বাভাবিক কার্য কে ব্যাহত করে, মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। টিউমার বিনাশ বা অপসারনের মাধ্যেমেই শুধু বেঁচে থাকা সম্ভব।
ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বা ক্ষতি কারক বৃদ্ধি:(কারসিনোমা)
দেহের ভিতর বাহির যে কোন স্থানে এই বৃদ্ধি জীবন হানীর কারণ হতে পারে।
টিউমার আক্রান্ত কোষ টি দ্রুত গতিতে অনিয়মিত বিভাজন হতে থাকে এবং একটা সময়ে ফেটে যায়। ফেটে যাওয়া টিউমারটির ম্যালিগন্যান্ট কোষ গুলো রক্ত স্রোতের মাধ্যমে দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং দেহের এক স্থান হতে অন্য স্থানে গিয়ে নতুন টিউমার এর সৃষ্টি করে। একেই বলে ‘ম্যাটাসটেসিস’। এ ছাড়া ম্যালিগন্যান্ট টিউমার, এর চারিপাশের স্বুস্ব্য স্বাভাবিক কোষ গুলোকে আক্রন্ত করে ‘ন্যাক্রোসিস’ ঘটায়। কোন অঙ্গ যেমন ,মস্তিষ্ক,হার্ট,লিভার ,কিডনি,ফুসফুস ও রক্ত কোষে এ ধরনের টিউমার হলে,মৃত্যুই হচ্ছে সর্বশেষ গন্তব্য।
ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার প্রতিষ্ঠিত কারণগুলো:
বাহ্যিক রাসায়নিক পদার্থ,বিকিরন,কিছু ভাইরাস,ধীর বিষক্রিয়া,দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত,অভ্যন্তরীন হরমোনের গোলমাল,পুষ্টির অভাব,নিয়মিত ব্যয়াম না করা ,রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া.ধুমপান,অস্বাস্ব্যকর খাবার, অতিরিক্ত চর্বি ও প্রোটিন যুক্ত পশুর মাংশ,অতিরিক্ত ক্যালরি।
এক তৃতীয়াংশ ক্যান্সার এর কারণ ত্র“টি পূর্ন খাবার । ৯০শতাংশ ফুসফুস এর ক্যান্সার এর জন্য দায়ী ধুমপান। (Ref.WHO Technical Report
series 797,1990)। ৮০ শতাংশ প্রচলিত ক্যান্সার এর কারণ ত্র“টিপূর্ন জীবন যাত্রা এবং পরিবেশর ভারসাম্যহীনতা (Sheron 1989)।
ক্যান্সার এর বংশগত কারণ:
প্রতি কোষের ক্রমোজম এ অবস্থিত DNA এর মধ্যে জীবনের সব তথ্য সংরক্ষিত থাকে। আর একটি কোষে এ ধরনের ডি এন এ এর সংখ্যা ১ লক্ষ। প্রতিটি ডি এন এ সর্বনিন্ম ৬০০ থেকে সর্ব্বোচ্চ কয়েক লক্ষ ‘নিউক্লিওটাইড’এর জোড়া দিয়ে তৈরি। এভাবে কোষের তথ্য বহনকারী DNA এর এককই ‘জিন’ বলে। মানব দেহ কোষে কিছু ‘জিন’ আছে ,যারা কোষের প্রজনন ও বিশেষায়িত হওয়ার নির্দেশনা দেয়। এ জিনগুলো কে ‘রেগুলেটরী জিন’ বলে। এভাবে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী জিন ‘অনকোজিন’এবং ‘টিউমার দমনকারী জিন’ বিজ্ঞানীরা সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। বিজ্ঞানীরা একটি ‘জিন’ সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন যা ধুমপায়ীদের ফুসফুস ক্যান্সার এর হাত হতে থেকে রক্ষা করে। এ জিনের জন্যই কিছু মারাত্মক ধুমপায়ীদের ফুসফুস ক্যান্সার হতে দেখা যায় না। এভাবে কিছু জিন বিজ্ঞানীরা সনাক্ত করেছেন যা,ডাইবেটিস রোগ,উচ্চ রক্তচাপ,মোটা হয়ে যাওয়া,কিছু মারাত্মক রক্ত রোগ যেমন,থ্যালাসেমিয়া,মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর জন্ম গত ত্র“টির জন্য দায়ী । বংশগতির প্রতিটি তথ্য সংরক্ষনের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট ‘জিন’। যেমন চোখের রং,উচ্চতা,বডির আকার,রক্তের গ্র“প,এভাবে প্রায় এক লক্ষ জিন আছে। কোষ বিভাজনের সময় কোষের জিন গুলো হুবহু কপি হয়ে সৃষ্ট নতুন কোষে স্থানান্তরিত হয়। যার কারনে নতুন কোষ জীবনের পূনাঙ্গ তথ্য বহন করে। কোষ বিভাজনের সময় যদি কোন ত্রটি থাকে থাকে তা হলেই সৃষ্ট নতুন কোষের জিন এর বিভিন্ন পরিবর্তন সংগঠিত হয়। পরিবর্তীত জিনই পরবর্তীতে বংশগতির নানা অসংগতি দেখা যায়। এবং ক্যানাসার এর মত রোগের সৃষ্টি করে।
কারসিনোজেন:
এটি ক্যান্সার উৎপাদনকারী এজেন্ট। এই কারসিনোজেন পরিবেশের তৈরি বা মানুষের সৃষ্টি দুইই হতে পারে। নিন্মে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান গুলো নিয়ে (কারসিনোজেন) আলোচনা করা হলো:
>
রাসায়নিক পদার্থ এবং শিল্প বর্জ:
বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ এবং শিল্প বর্জ ক্যান্সার সৃষ্টির অন্যতম কারণ। শুটকি সংরক্ষনে রাসায়নিক পদার্থ DDT ক্যান্সার তৈরি করে। কৃষক গন যারা বিভিন্ন কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন তাদের বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা থাকে। কল কারখানার রাসায়নিক শিল্প বর্জ বাতাস ,মাটি ও পানিকে দুষিত করছে যা,বিভিন্ন ধরনের ক্যানাসার সৃষ্টির জন্য দায়ী ।
>
বিকিরন ও পরিবেশ দূষন:
বিভিন্ন তেজষ্ক্রিয় পদার্থ থেকে বিকিরন কোষের DNA এর স্থায়ী ক্ষতি করে যা কোষের ক্যান্সার রোগ তৈরি করে। যেমন,এক্স-রে,রেডন,মহাজাগতিক রশ্মি,অতিবেগুনি রশ্মি। বিভিন্ন প্যাথলজিক্যল পরীক্ষায় ব্যবহৃত রাসায়নিক যৌগ,বিভিন্ন যন্ত্র কৌশল যেমন,সিটি স্ক্যান (CT Scan) ,এম আর আই , (MRI) পেট স্ক্যান (PET Scan).বেরিয়াম,এক্স-রে ইত্যাদী। তেজষ্ক্রিয় বিকিরন ফুসফুস,চর্ম,হাড় এর ক্যান্সার সৃষ্টি করে।
> টোবাকো (তামাক জাত দ্রব্য): তামাক জাত দ্রব্য ব্যবহারের কারনে ৩৪ ধরনের বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ হয়। এবং মৃত্যুর হার অনেক বেশি। তামাক এ চার হাজার ধরনের রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ ধরনের পদার্থ আছে যা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। ৯০শতাংশ ফুসফুস ক্যান্সার এর জন্য দায়ী টোবাকো। টোবাকোর আসক্তি ক্ষমতা হিরোইন ও কোকেইন এর আসক্তির সমান। নিকোটিন হচ্ছে একটি টক্সিক উপাদান যা টোবাকোতে পাওয়া যায়। এটি হিরোইন এর চেয়ে শক্তিশালী। নিকোটিন মস্তিষ্ককে ৬ সেকেন্ডে আঘাত করে অপর পক্ষে হিরোইন এর সময় লাগে ১২ মিনিট। মুখের ক্যান্সার এর জন্য তামাক জাত দ্রব্যই দায়ী।
>ভাইরাস: অনকোজিন ভাইরাস ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। মানুষের ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী ভাইরাসগুলো হচ্ছে; এপসটেইন-বার ভাইরাস (Epstain-Barr Virus EBV)। বারকিট লিম্ফোমা বা বি-সেল লিম্ফোমা (B-Cell lymphoma) এবং ন্যাসো-ফ্যারিনজিয়াল ক্যান্সার এর জন্য এই ভাইরাস দায়ী। অধিকিন্তু ৫০শতাংশ হজকিন লিম্ফোমা বা টি-সেল লিম্ফোমা (T-Cell Lymphoma) এর জন্য দায়ী । ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী অপর ভাইরাস হলো ;হেপাটাইটিস বি ভাইরাস (HBV)। ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর রক্ত গ্রহণ এবং যৌন সম্পর্ক করার মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। এটি লিভার ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। হিউমেন প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) যৌন মুখের (সারভিক্স) ক্যান্সার এর জন্য দায়ী। ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সাথে যৌন সম্পর্ক এর কারনে এই রোগ ছড়ায়। হারপেস সিমপ্লেক্স ভাইরাস (HSV)
এর কারনে মুখের ক্যান্সার হয়। হিউম্যান ইমিউন ভাইরাস, (HIV)
দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর রক্ত গ্রহণ এবং যৌন সম্পর্ক করার মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়।
>ফাংগাস: ফাংগাস ‘এসপারজিলাস ফ্ল্যাভাস’, এক ধরনের টক্সিন যার নাম ‘এ্যাফ্লাটোক্সিন’ (Aflatoxin) নিঃসরন করে। এই টক্সিন লিভার ক্যান্সার এর জন্য দায়ী। এই ফাংগাস সাধারনত মজুদকৃত খাদ্যে জন্ম নেয়। তাপ এবং রান্নার মাধ্যমে ও এ টক্সিন নষ্ট হয় না। ভাল করে ধুঁয়ে রান্না করলে এই টক্সিন নষ্ট হয়। শস্য বীজ যেমন, গম,চাল,ডাল প্রভৃতি দীর্ঘদিন মজুদ রাখলে এই টক্সিন জন্ম নেয়।
বাসী ও পুরাতন খাবার এ ফাংগাস জন্ম নেয়। তাই বাসী ও পুরাতন খাবার খেলে ‘লিভার ক্যন্সার ’ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
>
ব্যাকটেরিয়া:‘হ্যালিকোব্যাকটার পাইলোরি (H.Pylori) নামের এই ব্যাকটেরিয়া ‘গ্যাসট্রিক ক্যান্সার’ এর জন্য দায়ী। (Hausen 1994)
>এ্যলকোহল এবং বেভারেইজ
(মদ ও কোমলপানীয়):
অতিরিক্ত এ্যলকোহল পানকারীদের মুখ,গলনালী,কোলন,ফেরিংস,ল্যারিংস এর ক্যান্সার ঘটায়। মেয়েদের এ্যলকোহল পানে ব্রেষ্ট ক্যান্সার এর ঝুঁকি দ্বিগুন থাকে। বিয়ার পানে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। (National Research council
1982 ,USA)। রেকটাল ক্যান্সার এর ঝুঁকি আছে বিয়ার পানে।(WHO) । এলকোহল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এ্যলকোহল পানকারীদের ভিটামিন-‘এ’ ,
‘সি’ ,
ফলিক এসিড, এবং ভিটামিন-বি, জিংক, সেলেনিয়াম এর অভাব হয়। (National Research council 1982 ,USA)। এই ভিটামিন গুলোর অভাবে দেহে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
>
ফ্রী রেডিক্যাল
(মুক্ত আয়ন): এটি হচ্ছে আধান যুক্ত একটি মুক্ত অনু বা পরমানু যারা সব সময় সক্রিয় থাকে। যেমন,অক্সিজেন আয়ন ও হাইড্রোজেন আয়ন। অক্সিজেন এর উপস্থিতিতে কোষ অনেক বেশি শক্তি তৈরি করে। আবার অক্সিজেন মুক্ত আয়ন কোষের বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ এবং কোষ প্রাচীর নষ্ট করে দেয়। চর্বি সবচেয়ে বেশি মুক্ত আয়ন দ্বারা আক্রমনের শিকার হয়। কোষ প্রাচির চর্বি দ্বারা নির্মিত হয় । তাই মুক্ত আয়ন দ্বারা কোষ প্রাচীর আক্রান্ত হয়। মুক্ত আয়ন কোষ মধ্যস্থ DNA এর গঠনে পরিবর্তন ঘটায় যা,ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। ফ্রী রেডিক্যাল বা মুক্ত আয়ন তৈরি হয় সাধারনতঃ শিল্প বর্জ , ভারী ধাতু যেমন,পারদ,বিকিরন দূষন প্রভৃতি হতে। কোষের শ্বসন ও মেটাবলিজম অসম্পূর্ন থাকলে বিশেষ করে চর্বি ও প্রোটিন ভাঙ্গন ঠিকমত না হলে দেহে মুক্ত আয়ন তৈরি হয়।। (Fight Against
Cancer.by Dr.A Q.Khan)
>নাইট্রাইটস এবং নাইট্রেটস:‘নাইট্রোসএমাইন’ একটি ক্যান্সার উদ্দিপনাকারী পদার্থ যা পাকস্থলীতে তৈরি হয়। খাদ্যে থাকা এমাইন, বাহির উৎস থেকে আসা নাইট্রাটস মিলে এটি তৈরি হয়। নাইট্রাইটস ও নাইট্রেটস খাদ্যের রং এবং সংরক্ষনে ব্যবহৃত হয়। (Fight Against Cancer.Dr.A.Q.Khan)
>জন্ম নিরোধক ঔষধ:
জন্ম নিরোধক ঔষধের সাথে লিভার ক্যান্সার এর সম্পর্ক আছে। (KewCM.1994)।
>এসট্রোজেন:
এটি একটি হরমোন। মেয়েদের মেয়েলি বৈশিষ্ট্য গুলো এই হরমোনের সাহায্যে পরিস্ফুটিত হয়। রজঃ নিবৃত্তির পর এই হরমোন নিঃসরন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে নানা রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। শারীরিক সমস্যা গুলো দূর করার জন্য ‘এসট্রোজেন চিকিৎসা’ দেয়া হয়। এই এসট্রোজেন চিকিৎসা জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার এর অন্যতম কারণ।। (Fight Against Cancer.Dr.A.Q.Khan)
>ওভার ওয়েট:
অতি ওজন ক্যান্সার এর অন্যতম কারণ। স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে ২০ শতাংশ ওজন ক্যান্সার এর ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন,জরায়ু, পিত্তথলী, কিডনি, প্রসট্রেট, জরায়ুমূখ, কোলন, এবং স্তন এর ক্যান্সার । (Miller 1992).
>খাদ্য ও জীবন পদ্ধতি:
এক তৃতীয়াংশ ক্যান্সার এর কারণ ত্র“টিপূর্ন খাবার ও জীবন যাত্রা। কম পুষ্টি সম্পন্ন অতিরিক্ত খাবার ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। অতিরিক্ত পশু প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় খাবার প্রসট্রেট, স্তন, পিত্তথলী এবং জরায়ুর এন্ড্রোমেট্রিয়াম ক্যান্সার এর জন্য দায়ী। (Miller 1992,Osler1987) কোল-রেকটাল ক্যান্সার এর সাথে পশু চর্বি ও লাল মাংশ খাওয়ার সম্পর্ক গবেষনার মাধ্যমে প্রমানিত। অতিরিক্ত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার ‘প্যাংক্রিয়াস ক্যান্সার’এর জন্য দায়ী। (Howatson 1983)। টোস্ট এবং ফ্রাইড পটেটোস এ ক্যান্সার উৎপাদন কারী পদার্থ তৈরি হয়। উচ্চ তাপে মাংশ রান্না করলে বা ভাজলে প্রোটিন ও ফ্যাট একাত্রিত হয়ে ক্যান্সার উৎপাদনকারী পদার্থ ‘বেনজো পাইরিন’ তৈরি হয়। স্মোকড ফুড ,টার শোষন করে নেয়। এই টার ক্যান্সার উৎপাদনকারী পদার্থ ধারন করে যা,ধুমপানের টার এর মত সমান ‘কারসিনোজেন’।
>
উচ্চ চর্বি যুক্ত খাবার:
সব ধরনের উচ্চ চর্বি যুক্ত খাবারের সাথে ক্যান্সার এর সম্পর্ক রয়েছে। (Garison 1985). চর্বি, ফ্রী রেডিক্যাল দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়। কোষ প্রাচীর সম্পৃক্ত ও অসম্পৃক্ত চর্বি দ্বারা নির্মিত হয়। ফ্রী রেডিক্যাল (মুক্ত আয়ন) দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কারনে কোষ প্রাচীর নষ্ট হয়ে অসুস্থ হয়। অসুস্থ কোষ বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ (টক্সিন) এর নিঃসরন ঘটায় যা ক্যান্সার এ পরিণত হতে সাহায্য করে। ফ্রী রেডিক্যাল কোষের ডি এন এ এর পরিবর্তন ঘটায় যা কোষের বংশগতির তথ্যের ধারাবাহিকতা নষ্ট করে। অক্সিডেশন এর কারনে চর্র্বি পরিবর্র্তিত হয়ে রক্ত নালীতে থিতিয়ে পড়ে। এর ফলে হৃদপিন্ডের রক্তনালী বন্ধ হয়ে যে রোগের সৃষ্টি হয় একেই ‘করোনারী আর্টারী ডিজিজ’ বলে। বেশি চর্বি যুক্ত খাবার ,কোলেস্টরল উৎপাদন ও নিঃসরন বৃদ্ধি করে এবং পিত্তের মাধ্যমে ক্ষুদ্রান্তে এর নিঃসরন ঘটায়। এই অতিরিক্ত কোলেস্টরল যুক্ত পিত্ত ক্ষুদ্রান্তের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিবর্তন ঘটায়। এই পরিবর্তিত ব্যাকটেরিয়া ,পিত্ত থেকে নতুন যৌগ তৈরি করে যা,কোলন ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। কিছূ কার্ডিওভাসকুলার ঔষুধ , কোলেস্টেরল নিঃসরন বৃদ্ধি করে যা,কোলন ক্যান্সার এর কারণ। (Report from Committee of Principal Investigation 1978). উচ্চ চর্বি যুক্ত খাবার ‘ব্রেষ্ট ক্যান্সার ’ সৃষ্টি করে। উচ্চ চর্বি খাবার, ‘এসট্রোজেন’ (
মেয়েদের বৈশিষ্ট্য নির্ধারনকারী হরমোন) এর পরিবর্তন ঘটায় যা,স্তন ক্যানসার এর জন্য দায়ী। উচ্চ চর্বি যুক্ত খাবার ২ হতে ৩ গুন ‘ডিম্বাশয় ক্যান্সার’(ওভারিয়ান) এর ঝুঁকি বাড়ায়। (National Research Council 1982).
.>প্ল্যান্ট ফাইবার
(উদ্ভিদ তন্তু): পলিস্যাকারাইড, সেলুলোজ, পেকটিন, লিগনিন, মিউসিলেজ,গামস, প্রভৃতি প্ল্যান্ট ফাইবার ক্ষুদ্রান্তে হজম হয় না। এই ফাইবার বৃহদান্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে পুরোপুরি বা আংশিক হজম হয়। প্ল্যান্ট ফাইবার পানিতে দ্রবনীয় ও অদ্রবনীয় দুই ধরনের হয়। ফল,অটস,বারলি,লেগুম (দ্বি-বীজ জাতীয় শস্য) অতি দ্রবনীয় কার্বহাইড্রেট। পাকস্থলীর ক্যান্সার প্রতিরোধ এর জন্য অত্যন্ত কার্যকর হচ্ছে, ‘হূইট ব্রান’। এটি বাউল এর গতিকে বাড়িয়ে দেয় ফলে ক্যান্সার সৃষ্টি কারী পদার্থ গুলো বেশি ক্ষন খাদ্য নালীতে অবস্থান করতে পারে না। হেমিসেলুলোজ এবং লিগনিন অদ্রবনীয় তন্তু । হেমিসেলুলোজ সম্পূর্ন খাদ্য শষ্য (Whole grain) এ পাওযা যায়। লিগনিন সম্পূর্ন খাদ্য শস্য , ফল,এবং শবজিতে পাওয়া যায়। লিগনিন একটি ভাল ‘এন্টিঅক্সিডেন্ট’ যা, কোষকে ফ্রী রেডিক্যাল এর আক্রমন হতে রক্ষা করে।
৪০শতাংশ ক্যান্সার এর কারণ নিন্মে উল্লেখ করা হলো: (United State 1982).
রিক্স ফ্যাক্টর
|
% ক্যান্সার
|
অস্বাস্থ্যকর খাবার
|
২৫% হতে ৩৫%
|
ধুমপান
|
২৫% হতে ৩০%
|
পেশাগত বিষ প্রবেশ
|
১০% হতে ২০%
|
পরিবেশগত বিষ প্রবেশ
|
১০% হতে ২০%
|
এলকোহল
|
৩% হতে ৫%
|
লেগুমস (দ্বি-বীজ জাতীয় শস্য) হচ্ছে ভাল দ্রবনীয় তন্তু । এটি কোলনে ফ্যাটি এসিড এর সাথে যুক্ত হয়ে মলের সাথে নির্গত হয়।
ফলে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল জমা হতে পারে না।
Click part-2 : Read more
Click part-2 : Read more